করোনাকালে বর্ষবরণ : জয় করো এই তামসীরে



            জীর্ণ পুরাতন যাক ভেসে যাক!
            আমরা শুনেছি ওই মাভৈঃ মাভৈঃ মাভৈঃ
            কোন নূতনেরই ডাক।

রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, প্রকৃতিতে বৈশাখ আসে নূতনের আহ্বান নিয়ে। তাই বাংলা বছরের প্রথম মাস বৈশাখকে বরণ করতে, প্রতি বছর চৈত্রের মাঝামাঝি সময়টা থেকে, উৎসবের রঙে সেজে উঠতে থাকে বাংলাদেশ। বিগত বছরের নিস্ফল সঞ্চয়কে পরিত্যাক্ত করে বাংলা নতুন বছরকে বরণ করতে উন্মুখ থাকে বাঙালি। প্রাণের টানে রাতের আঁধারকে ম্রিয়মান করে যেন আকাশ প্রদীপ জ্বালিয়ে চলে বর্ষবরণের আয়োজন। উৎসাহ পরতে পরতে! চৈত্র সংক্রান্তী, হালখাতা, বৈশাখী মেলা, ছায়নটের বর্ষবরণ, চারুকলা অনুষদের মঙ্গল শোভাযাত্রায়, পার্বত্যবাসীদের বৈসাবী উৎসবে- প্রাণের স্রোত উদ্বেলিত করে তারুণ্যের শক্তিকে। এই আনন্দ মুখরতা যেন বাঙালি চেতনার নির্ভেজাল প্রকাশ।


আবহমান কাল ধরে জাতি ধর্মের বেড়া ডিঙিয়ে বাঙালির সর্বজনীন ও অসাম্প্রদায়িক উৎসব পহেলা বৈশাখ। জাতীয়ভাবে, বাংলা ১৪১৭ সাল থেকে নানা আয়োজনে নতুন বাংলা বছরকে বরণ করার রেওয়াজ শুরু হয়।

পহেলা বৈশাখকে বরণ করার এই আমেজে যেমন মিশে থাকে ভালোলাগা, তেমনি আকুলতা জাগায় লাল-সাদা শাড়ি, কাচের চুড়ি, মাটির গয়না, খোঁপায় গোঁজা ফুল বা পাঞ্জাবী-পাজামায় অনবদ্য বাঙালি সাজে সেজে ওঠার। বৈশাখের প্রাতরাশে পানত্মা-শুঁটকি- ইলিশ, সাথে সবুজ লঙ্কা- পেয়াজ-নুন। আর শেষপাতে মিষ্টান্ন, ফলার। এই নিয়েই উৎসবপ্রিয় বাঙালি মেতে ওঠে প্রাণের উৎসবে। এখনো গ্রামীন সমাজে বছরের প্রথম দিন সামর্থ অনুযায়ী ভালো রান্না, খাওয়া, নতুন পোশাক পরিধানের রেওয়াজ আছে। নতুন বছরের উৎসব যেন নতুনভাবে চলা ও বাঁচার উৎসব। এ এক পরম বিশ্বাস- বছরের প্রথম দিন যদি আনন্দে-খুশিতে কাটে, তবে বছরের বাকী দিনগুলোও তেমনই কাটবে। জাতিগত অনুভূতিতে আপ্লুত করে, আবৃত করে পহেলা বৈশাখ। এই অনুভূতি মহৎ উদ্দীপক-উৎসাহব্যঞ্জক।

সংকটময় এই কালেও বর্ষ পঞ্জিকা জানান দেয় নতুনের আগমনী বার্তা। তাই প্রকাশ্যে না হোক, অন্তত মনের গহীনে উৎসবের সুপ্ত আমেজ দোলা দেয়, রবি ঠাকুরের গানে সুর মিলিয়ে বাঙালি মন গেয়ে ওঠে-

               বৈশাখ হে, মৌনী তাপস, কোন অতলের বাণী
                    এমন কোথায় খুঁজে পেলে।
               তপ্ত ভালের দীপ্তি ঢাকি মন্থর মেঘখানি
                 এল গভীর ছায়া ফেলে।।


বৈশাখ কিভাবে হয়ে উঠল শুভারম্ভের মাস, এমন তথ্য কম বেশী সবার জানা। প্রাবন্ধিক, গবেষক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন শাহজাহান তাঁর ‘বাংলা সনের জন্মকথা’ বইয়ে এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার উদ্বৃতি দিয়ে বলেন- প্রাচীন ভারতীয় ও বিদেশী সনের পাশাপাশি মোঘল সম্রাট আকবর কয়েকটি নতুন সনের প্রচলন করেন। তন্মধ্যে বাংলাদেশের জন্য বাংলা সন, উড়িষ্যা এলাকার জন্য আমলী সন, বিলায়েতী, ফসলী বা মৌসুমি, অঞ্চল বিশেষের জন্য খুরাশান, মহারাষ্ট্র এলাকার জন্য এবং তার রাজ্য সন হিসেবে ইলাহী সন। (মোশারফ, ২০০১: ৫৩)

সম্রাট আকবর এক সময় উপলব্ধি করলেন- চান্দ্র সনে চন্দ্রের অস্থিরতার কারণে প্রতি বছর নির্দিষ্ট সময়ে খাজনা আদায় করতে নানা অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়। তাঁর রাজস্ব কর্মচারীরাও অনুরোধ জানান- উদ্ভুত সমস্যা সমাধানের। তখন আকবর সৌর সনভিত্তিক একটি নতুন সন প্রবর্তনের জন্য দরবারের রাজস্ব কর্মকর্তা, প্রজ্ঞাসম্পন্ন মনীষী আমির ফতে উল্লাহ শিরাজীর উপর দ্বায়িত্ব অর্পণ করেন। ফতে উল্লাহ শিরাজী সম্রাট আকবর এবং তাঁর প্রজাদের খাজনা পরিশোধের নানা সুবিধার দিক বিবেচনা করে, একটি সৌর সন প্রবর্তন করেন। ইত:পূর্বে বর্ষ গণনার ‘মলমাস’ এর পরিবর্তে ফতে উল্লাহ শিরাজীর উদ্ভাবিত সনকে অধিক ত্রুটিমুক্ত ও বিজ্ঞানসম্মত বলেও স্বীকৃতি দেয়া হয়। তখন থেকে এই বাংলা সন একই সাথে বাংলার ঐতিহ্য এবং লোকসংস্কৃতির ধারক।

এখানে উল্লেখ্য- ৯৯২ হিজরি মোতাবেক ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ বা ১১ মার্চ থেকে বাংলা সন গননা শুরু হলেও এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় সম্রাট আকবরের সিংহাসনে আরোহনের বছর ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ বা ৯৬৩ হিজরি থেকে। ৯৬৩ হিজরি সালের মুহররম মাস ছিলো বাংলা বৈশাখ মাস। যে কারণে বৈশাখ মাসকেই বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস, সেইসাথে পহেলা বৈশাখকেই নববর্ষ হিসেবে ধরা হয়। প্রথম দিকে নতুন এই সনটি পরিচিতি পেয়েছিলো ফসলি সন হিসেবে। পরে তা বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিতি পায়।


পহেলা বৈশাখেই জমিদারের খাজনা হালনাগাদ করা হতো। পুরণো খাতায় বাকীর হিসেব করে গ্রাহকদের নিমন্ত্রণ জানানোর রেওয়াজ প্রচলিত ছিল। বছরের প্রথম দিন গ্রাহকরা বাকীর হিসেব মিটিয়ে মিষ্টিমুখ করে বিদায় নিত। যারা পুরো বকেয়া শোধ করতে পারতো না, তাদের নাম উঠত নতুন হিসেবের খাতায়। এই হিসাব হাল নাগাদের জন্য ব্যবহৃত হতো লাল রঙের খাতা, যা হালখাতা নামে প্রচলিত। বছরের শুরু থেকেই বিশুদ্ধ ভাবে, ঋণমুক্তভাবে জীবন শুরু করার দর্শন থেকেই হালখাতার প্রচলন। আধুনিক যুগে এর চল কমে এলেও পুরাণ ঢাকার তাঁতী বাজার ও শাঁখারী বাজারের কিছু স্বর্ণকারের দোকানে, শ্যামবাজারের আড়ৎ এবং ইসলামপুরের কাপড়ের দোকানে এই ঐতিহ্যের চর্চা টিকে আছে এখনো। ঐ দিন দোকান ধোয়া মোছার কাজ চলে। অনেক জায়গায় হালখাতা উপলক্ষে নিমন্ত্রণপত্রও ছাপানো হয়।

নতুন বছর সবসময়ই নতুনভাবে জাগ্রত করেছে শুভ চেতনা, দূর করতে চেয়েছে সব জাতিগত বিভেদ। তাই এই উৎসব সার্বজনীন। এই উৎসবকে ঘিরে নানা আয়োজনের একটি, রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ। ১৩৭১ বঙ্গাব্দের পহেলা বৈশাখ রমনার বটমূলে ছায়ানট বাংলা বর্ষবরণ উৎসব শুরু করে। 


চারুকলা অনুষদের মঙ্গল শোভাযাত্রাও বর্ষ বরণের এক অনুষঙ্গ। স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে এবং সকল অপশক্তির অবসান কামনায় ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে আনন্দ শোভাযাত্রার প্রবর্তন হয়। যার নাম পরবর্তীতে হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। বিশালাকার চারুকর্ম সহযোগে এই মঙ্গল শোভাযাত্রা ২০১৬ খ্রিস্টাব্দের ৩০ নভেম্বর ইউনেস্কোর অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়।

এই উৎসবে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ঘটা করে আয়োজিত বৈশাখী মেলা- বাঙালির আনন্দঘন লোকায়ত সংস্কৃতির ধারক। এদিকে,  ত্রিপুরাদের বৈসুক, মারমাদের সাংগ্রাই আর চাকমাদের বিজু- এই নিয়ে বৈসাবি উৎসব। চৈত্র সংক্রান্তি আর পহেলা বৈশাখ মিলিয়ে পালন করা হয় বৈসাবি উৎসব।

দুর্যোগকালের আগত নতুন বছর এই প্রত্যাশা জাগায়- চলমান জীবনের প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করতে, সব সংকীর্ণতার উর্ধ্বে উঠতে, বৈশাখের ঝড়ো বাতাস যেন উড়িয়ে নিয়ে যায় অপসংস্কৃতির কালো ছায়া! যার দোর্দন্ড প্রতাপে অশুভ শক্তি বিনাশ হয়ে জন্ম নেবে নতুন মানব। হবে শুভ চেতনার মুক্তি। এই বোধ ছড়িয়ে যাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে- সৃষ্টির সেরা মানুষই, অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে! রবীন্দ্রনাথের কথায়-

‘ওই বুঝি কাল বৈশাখী
সন্ধ্যা আকাশ দেয় ঢাকি।।
ভয় কীরে তোর ভয় কারে, দ্বার খুলে দিস চারধারে
শোন দেখি ঘোর হুঙ্কারে নাম তোরই ঐ যায় ডাকি।।
যা ভাঙ্গা তাই ভাঙ্গবে রে- যা রবে তাই থাক বাকি।।’


নববর্ষ নতুন করে হিসেব মেলানোর দিন। জীবনের সফলতা আর ব্যর্থতার হিসেব কষে নতুন আশায় নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর দিন। তারপরও, এই একবিংশ শতকে মানুষে মানুষে অবিশ্বাস, আস্থাহীনতা, পরশ্রীকাতরতা, ক্ষমতার লড়াই, মানুষের শুদ্ধ চেতনা যেন বিলুপ্ত।

মায়ার কুজ্ঝটিজাল সরিয়ে নতুন বছরের সূর্যোদয় বয়ে আনবে নতুন আশার আলো। বিগত বছরে অপঘাত, অপসংস্কৃতিকে মোকাবেলা করতে দূরদর্শী, মানবতাবাদী, নির্মল চরিত্রের নতুন মানবের আবির্ভাব ঘটুক। অন্ধবিশ্বাস, ধর্মীয় গোঁড়ামি আর কুসংস্কারের বেড়াজাল ছিন্ন করে মানুষ গাইবে জীবনের জয়গান। সাম্প্রদায়িকতা আর সংস্কৃতির বিভাজন রোধ করে, নতুন কর্মোদ্দীপনায় দুর্যোগ কাটিয়ে ওঠার আহ্বানে সরব হয়ে উঠবে বাঙালি। আগত বছরটি যেন বছর শেষে ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনায় পরিণত না হয়- এই প্রত্যাশায়, আশার আলো খুঁজে পাওয়া যায় রবীন্দ্রনাথের বাণীতে-
        
তুমি নির্মল কর, মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে।।
           তব পূণ্য কিরণ দিয়ে যাক মোর
              মোহ কালিমা ঘুচায়ে।।



তামান্না জেনিফার

0/Post a Comment/Comments

Previous Post Next Post